বর্তমান যুগের কুসংস্কার
বর্তমান সমাজে এখনও অনেক কুসংস্কার প্রচলিত আছে যা সমাজের মানুষ অন্ধের মতো অনুসরণ করে। যদিও আগের তুলনায় মানুষ কিছুটা সচেতন হয়েছে, তবুও কুসংস্কার থেকে পুরোপুরি মুক্তি পায়নি। আমরা জানি, কুসংস্কার মানা ও প্রচার করা শিরকের অন্তর্ভুক্ত। তাই এটি পরিহার করা এবং সমাজ থেকে দূর করা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কুসংস্কার সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য এটি জানা জরুরি—কুসংস্কার কী?
কুসংস্কার বলতে কী বোঝায়?
কুসংস্কার হলো এমন একটি বিশ্বাস বা আচরণ, যা যুক্তি, বিজ্ঞান বা ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। এটি সাধারণত ভয়ের উপর ভিত্তি করে এবং যাদু, ভাগ্য, বা অলৌকিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। সহজ ভাষায়, কুসংস্কার হলো মানুষের তৈরি অযৌক্তিক এবং ভিত্তিহীন বিশ্বাস বা কাজ, যা কোনো বৈজ্ঞানিক বা ধর্মীয় সমর্থন পায় না।
সহজ কথায় কুসংস্কার কি?
কুসংস্কার হলো এমন একটি বিশ্বাস বা প্রথা যা যুক্তি, বিজ্ঞান কিংবা ধর্মীয় ভিত্তি ছাড়াই প্রচলিত। এটি সাধারণত মানুষের অজ্ঞতা, ভয়ের মনোভাব, বা কোনো অজানা কারণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে। সহজ কথায়, কুসংস্কার হলো—
- অযৌক্তিক বিশ্বাস:
কোনো বিষয়কে এমনভাবে বিশ্বাস করা যার পেছনে কোনো যুক্তি বা বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। - ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীলতা:
কোনো বস্তু বা ঘটনাকে ভালো বা খারাপ ভাগ্যের কারণ হিসেবে ধরা। - ধর্মীয় অপব্যাখ্যা:
ধর্মের নামে এমন প্রথা বা বিশ্বাস যা প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ। - মনগড়া ধারণা:
প্রাচীনকালে কোনো নির্দিষ্ট কারণ বা প্রচলিত সংস্কৃতির অংশ হিসেবে যেসব আচরণ গড়ে উঠেছিল, সেগুলো এখন যুক্তিহীনভাবে অনুসরণ করা।
কুসংস্কারের সূচনা ও প্রভাব
কুসংস্কারের মূল উৎস সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ঐতিহ্য, সংস্কার বা ভুল ধারণা। আমাদের সমাজে এমন অনেক কুসংস্কার রয়েছে, যা কোনো কারণবশত অতীতে শুরু হলেও বর্তমান সময়ে তা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছে। তবুও মানুষ সেগুলো অন্ধভাবে অনুসরণ করে, যা ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
ধর্মীয় কুসংস্কার
ধর্মের নামে এমন অনেক বিশ্বাস এবং কাজ প্রচলিত রয়েছে, যা প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। এগুলো মূলত মানুষের মনগড়া এবং যুক্তিহীন ধারণার ফসল। ধর্মীয় কুসংস্কার শুধু ব্যক্তি জীবনের ওপর নয়, বরং পুরো সমাজের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। কিছু সাধারণ ধর্মীয় কুসংস্কার হলো:
- ঔষধ খাওয়ার সময় ‘বিসমিল্লাহ’ বললে রোগ বেড়ে যায়।
– এই ধারণা পুরোপুরি ভিত্তিহীন। বরং যেকোনো ভালো কাজ শুরুতে আল্লাহর নাম নেওয়া বরকতের কারণ। - ছোট বাচ্চাদের শরীরে লোহা জাতীয় কিছু বাঁধলে দুষ্ট জ্বীন-শয়তানের প্রভাব থেকে রক্ষা পাওয়া যায়।
– এটি সম্পূর্ণ কুসংস্কার। ইসলামিক দৃষ্টিকোণে জিকির ও দোয়ার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে নিরাপত্তা প্রার্থনা করতে হয়। - সন্ধ্যায় খালি ঘরে বাতি না জ্বালালে অমঙ্গল হয়।
– খালি ঘরে বাতি জ্বালানো একটি সামাজিক প্রথা হতে পারে, তবে এটি কোনো ধর্মীয় নির্দেশ নয়। - কুরআন শরীফ হাত থেকে পড়ে গেলে আড়াই কেজি চাল সদকা দিতে হয়।
– সদকা একটি সওয়াবের কাজ, তবে এটি ভুলের জন্য শাস্তি নয়। এমন কোনো নির্দেশনা ইসলামে নেই। - রাতে নখ, চুল, দাড়ি-গোঁফ কাটলে অমঙ্গল হয়।
– রাতে নখ বা চুল কাটার সঙ্গে কোনো ধর্মীয় বিধান নেই। এটি সম্পূর্ণ অযৌক্তিক। - মুরগির মাথা খেলে মা-বাবার মৃত্যুর সময় কাছে থাকা যাবে না।
– এটি কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। - ঘর থেকে বের হওয়ার সময় পেছনে ফিরে তাকালে যাত্রা ভঙ্গ হয়।
– ইসলামে যাত্রার ক্ষেত্রে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করার কথা বলা হয়েছে, পেছনে তাকানোর সঙ্গে যাত্রার কোনো সম্পর্ক নেই। - বিড়াল মারলে আড়াই কেজি লবণ সদকা দিতে হয়।
– পশু হত্যা ইসলামিক দৃষ্টিকোণে গুরুতর অপরাধ। তবে এটি সংশোধনের জন্য সদকার পরিমাণ নির্ধারণ করার কোনো ভিত্তি নেই। - শুকরের নাম মুখে নিলে ৪০ দিন মুখ নাপাক থাকে।
– শুকর হারাম, কিন্তু এর নাম নিলে মুখ নাপাক হয়—এমন কোনো নির্দেশনা ইসলামে নেই।
এ ধরনের কুসংস্কার মানুষের ধর্মীয় জ্ঞানহীনতার ফসল এবং এগুলো সমাজে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। ইসলামের সঠিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে এই ধরনের ভিত্তিহীন ধারণা দূর করা সম্ভব।
বিবাহ সংক্রান্ত কুসংস্কার
১. নতুন বউকে দুলাভাইয়ের কোলে করে ঘরে আনতে হবে। ( ইসলামে এটি সম্পূর্নরুপে হারাম)
২. বউকে শ্বশুরবাড়িতে নরম স্থানে বসালে বউয়ের মেজাজ নরম থাকে।
৩. মোহরানার টাকা মাফ করে দিলেই যথেষ্ট, পরিশোধ করতে হবে না।
৪. নতুন বউ শ্বশুরবাড়িতে আড়াই দিন অবস্থান করবে।
৫. নতুন জামাই বাজার না করা পর্যন্ত একই খাবার পরিবেশন করতে হবে।
পারিবারিক কুসংস্কার
১. জোড়া কলা খেলে জমজ সন্তান হবে।
২. ভাই-বোন মিলে মুরগি জবাই করা যায় না।
৩. ছোট বাচ্চাদের দাঁত ইঁদুরের গর্তে ফেলতে হয়, না হলে দাঁত বাঁকা হবে।
৪. ঘরের ময়লা পানি রাতে বাইরে ফেললে সংসারে অমঙ্গল হয়।
৫. ভাঙা আয়নায় চেহারা দেখলে অমঙ্গল হয়।
৬. সন্ধ্যার পর ঘর ঝাড়ু দেওয়া নিষেধ।
৭. বাচ্চাদের কু-নজর থেকে রক্ষা করতে কালো টিপ দেওয়া হয়।
সামাজিক কুসংস্কার
১. ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হবে।
২. রাতে বাঁশ কাটা যাবে না।
৩. তিন রাস্তার মোড়ে বসা অশুভ।
৪. কাক ডাকলে বিপদ আসে, শুকুন ডাকলে মানুষ মারা যায়।
৫. পাখি ডাকলে আত্মীয় আসবে।
ব্যবসায়িক কুসংস্কার
১. দোকানের প্রথম ক্রেতাকে ফেরত দেওয়া যাবে না।
২. সকালে দোকান খুলে নগদ বিক্রি না করে বাকিতে কিছু দেওয়া নিষেধ।
৩. দাড়িপাল্লা পায়ে লাগলে তা সালাম করতে হয়।
৪. রাতে কাউকে টাকা ধার দিলে ব্যবসায় ক্ষতি হয়।
কুসংস্কার দূর করার উপায়
কুসংস্কার সমাজে দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত থাকলেও সচেতনতা, শিক্ষা এবং ধর্মীয় সঠিক জ্ঞানের মাধ্যমে তা দূর করা সম্ভব। কুসংস্কার দূর করতে কয়েকটি কার্যকরী উপায় অনুসরণ করা যেতে পারে:
- শিক্ষার মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি:
কুসংস্কার দূর করার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপায় হলো সঠিক শিক্ষা প্রদান। স্কুল, কলেজ, মসজিদ, কমিউনিটি সেন্টারসহ বিভিন্ন স্থানে মানুষকে কুসংস্কারের বিপক্ষে সচেতন করা। - বৈজ্ঞানিক জ্ঞান প্রচার:
বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও তথ্যের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে যুক্তিযুক্ত চিন্তা-ভাবনা তৈরি করা। উদাহরণস্বরূপ, যারা ‘ব্যাঙ ডাকলে বৃষ্টি হবে’ বলে বিশ্বাস করেন, তাদের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিয়ে বিষয়টি পরিষ্কার করা। - ধর্মীয় শিক্ষা:
ইসলামের সঠিক জ্ঞান মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া। ধর্মীয় নেতাদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো, যাতে মানুষ প্রকৃত ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করে এবং কোনো অযৌক্তিক বিশ্বাসের প্রতি আগ্রহী না হয়। - মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে প্রচার চালানো এবং সঠিক তথ্য ছড়িয়ে দেওয়া। - অভ্যাসের পরিবর্তন:
কুসংস্কার মেনে চলা একটি দীর্ঘকালীন অভ্যাসের ফল। এসব অভ্যাস পরিবর্তন করার জন্য মানুষকে নতুন চিন্তাধারা ও আস্থা গড়তে উৎসাহিত করা। - অবশ্যই উদাহরণ তৈরি করা:
সমাজে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিরা যদি কুসংস্কারের বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং বাস্তবে এগুলো থেকে বিরত থাকেন, তবে সাধারণ মানুষ তাদের অনুসরণ করবে। - বিশ্বাসী মনোভাবের পরিবর্তন:
কুসংস্কার থেকে মুক্তির জন্য মানুষের বিশ্বাসের মধ্যে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। তাদের বোঝানো উচিত যে ভাগ্য বা অদৃশ্য শক্তির ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, নিজেদের কর্ম এবং চিন্তা-ভাবনার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করা সম্ভব।
এই উপায়গুলো অনুসরণ করলে সমাজে কুসংস্কারের রোধ করা সম্ভব এবং একটি সচেতন ও আধুনিক সমাজ গড়ে তোলা যেতে পারে।
উপসংহার
কুসংস্কার সমাজে অগ্রগতির পথে বড় বাধা। এটি মানুষের জীবনে ভীতি ও অযৌক্তিক আচরণের জন্ম দেয়। তাই কুসংস্কার পরিহার করে যুক্তি ও শিক্ষার আলোকে এগিয়ে চলাই আমাদের দায়িত্ব।
আরো পড়ুন সান্ডা কি সান্ডা খাও কি হালাল
Good