ডিপ্রেশন হলে কী কী সমস্যা হয়।

ডিপ্রেশন (বা বিষন্নতা) একটি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা, যা শুধুমাত্র মনের উপর নয়,শারীরিক এবং সামাজিক জীবনের ওপরও গভীর প্রভাব ফেলে। ডিপ্রেশন শুধু সাময়িক মন খারাপ বা দুখ:বোধ নয়, এটি একটি স্থায়ী এবং জটিল অবস্থা, যা ব্যক্তির দৈনন্দিন কার্যকলাপ, চিন্তা- ভাবনা, এবং শারীরিক শান্তিকে দুর্বল করে দিতে পার। ডিপ্রেশন যেকোনো বয়সের বা যেকোনো পেশার মানুষকে আক্রান্ত করতে পারে এবং এর কারণ হতে পারে জীবনের বিভিন্ন সমস্যাবলী,মানসিক চাপ,বা জেনেটিক প্রভাব।

এই সমস্যাটি শুরুতেই চিহ্নিত করা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সঠিক সময়ে চিকিৎসা ও সহযোগিতা না পেলে এটি মানুষের ব্যক্তিগত, পেশাগত এবং পারিবারিক ও সামাজিক জীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।ডিপ্রেশন হলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়, যা মনস্তাত্ত্বিক, শারীরিক, সামাজিক এবং আচরণগত হতে পারে।

১ ডিপ্রেশনে মানসিক সমস্যা

ডিপ্রেশনের বেশি লক্ষ্মণ দেখা যায় মানসিক অবস্থায়। আক্রান্ত ব্যাক্তি প্রায়শই গভীর দুঃখ,হীনমন্যতা, এবং বাঁচার ইচ্ছা হারিয়ে ফেলতে পারে। মনের ভেতর সব সময় হতাশা কাজ করতে থাকে।কেউ কেউ অনুভব করেন যে তারা মূল্যহীন, তাদের জীবনে আর কিছু ভালো হবে না,এবং তাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। এই অবস্থা মানুষকে বিষণ্ণ এবং নিঃসঙ্গ করে তুলতে পারে। অনেক সময় মানুষ তার জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করতে থাকে। যা আত্মহত্যার মতো মারাত্মক সিদ্ধান্তের দিকে নিয়ে যেতে পারে।

এছাড়া ডিপ্রেশনে ভোগা মানুষজন নিজের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। তারা নিজের কোনো কাজেই সন্তুষ্ট হতে পারে না এবং অনেক ক্ষেত্রে খুব সহজেই উদ্বিগ্ন হয়ে যায়। অনেক সময়, তারা কোন কাজ শেষ করার জন্য যথেষ্ট উৎসাহ খুঁজে পায় না, ফলে তাদের কর্মক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়।এক্ষেত্রে মনে হতে পারে যে প্রতিটি কাজই অত্যন্ত কঠিন এবং চ্যালেঞ্জিং।

২ ঘুমের সমস্যা

ডিপ্রেশন প্রায়ই ঘুমের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেকেই অনিদ্রা বা অপর্যাপ্ত ঘুমের সমস্যায় ভোগেন, আবার কেউ কেউ অতিরিক্ত ঘুমিয়ে সময় কাটানোর চেষ্টা করেন। ঘুমের সমস্যা একজন মানুষের দৈনন্দিন কার্যক্ষমতা কামিয়ে দিতে পারে, ফলে তারা সারাদিন ক্লান্তি অনুভব করেন এবং কার্যক্ষমতা কমে যায়। যথাযথ ঘুম না হওয়ার কারণে স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং মনোযোগের ঘাটতি দেখা দেয়।

ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তিদের মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যেতে পারে এবং পুনরায় ঘুমাতে অক্ষম হতে পারেন, যা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এর ফলে তাদের শারীরিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাও কমে যায় এবং বিভিন্ন শারীরিক অসুস্থতার ঝুঁকি বেড়ে যায়।

৩ শারীরিক অসুস্থতা

ডিপ্রেশনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো এর শারীরিক প্রভাব। ডিপ্রেশনে আক্রান্ত ব্যক্তিরা অনেক সময় বুকে ব্যাথা, মাথাব্যথা, পেশী ব্যথা, পেটে সমস্যা, বা ক্লান্তির মতো শারীরিক রোগের লক্ষণ অনুভব করেন। এগুলো সাধারণত মানসিক চাপের কারণেই হয়ে থাকে, শারীরিকভাবে প্রতিফলিত হয়।

অনেক সময় ডিপ্রেশনের কারণে ব্যক্তির ক্ষুধা কমে যায় বা বেড়ে যায়। কিছু লোক ডিপ্রেশনের সময় বেশি খাওয়ার দিকে ঝোঁকেন,অন্যদিকে কেউ কেউ একবারে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দেনএর ফলে ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে, যা আরও শারীরিক সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে।

সম্পর্কের সমস্যা

ডিপ্রেশন ব্যক্তির সামাজিক জীবনকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তিরা প্রায়শই আত্মগোপন করেন এবং বন্ধু -বান্ধব, পরিবার বা সহকর্মীদের থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন। তারা অন্যদের অন্যদের সাথে যোগাযোগ করতে অনিচ্ছুক হয়ে পড়েন,এবং তাদের সামাজিক সম্পৃক্ততা কমে যায়।

ডিপ্রেশন মানুষের সম্পর্কের মধ্যে ভুল বোঝ বঝি, দুর্বল যোগাযোগ, এবং বিচ্ছিন্নতার কারণ হতে পারে। ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তিরা প্রায়শই তাদের চারপাশের লোকেদের থেকে সহানুভূতি বা সমর্থন পেতে ব্যর্থ হন,যা তাদের মানসিক অবস্থাকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে।

৫ কর্মজীবনের সমস্যা

ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তিদের কর্ম জীবনেও নানা সমস্যা দেখা দেয়। অনেকে কাজের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন, যা তাদের কর্মক্ষমতা কমিয়ে দেয়। কাজের চাপের কারণে ডিপ্রেশন আরও বেড়ে যেতে পারে। যা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ হতে পারে। কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তির পারফরম্যান্স কমে যাওয়া, ভুল সিদ্ধান্ত নেওয়া, সময়মতো কাজ শেষ না করা, এবং প্রয়োজনীয় কাজগুলো অবহেলা করার কারণে তারা চাকরিতে সমস্যার সম্মুখীন হতে পারেন।

এছাড়াও, ডিপ্রেশন কর্মজীবন এর মধ্যে ট্রেস এবং হতাশার অনুভূতি সৃষ্টি করে, যা ব্যক্তির মানসিক অবস্থা আরও খারাপ করে তুলতে পারে। এর ফলে কর্ম জীবনে স্থায়ী ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দেয়।

৬ আত্মবিশ্বাসের অভাব

ডিপ্রেশনের কারণে মানুষের আত্মবিশ্বাস মারাত্মকভাবে কমে যায়। তারা তাদের নিজস্ব ক্ষমতা বা দক্ষতা সম্পর্কে সন্দেহ পোষণ করতে শুরু করে। অনেক সময় তারা নতুন কোনো কাজ শুরু করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। এবং পুরনো কাজগুলোও করতে অনীহা দেখান।

আত্মবিশ্বাসের এই ঘাটতি ব্যক্তির ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং তাদের সামনে থাকা সুযোগগুলোকে কাজে লাগাতে ব্যর্থ হতে পারে। এর ফলে ব্যক্তিগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি হয়।

৭ আত্মহানীর ঝুঁকি

ডিপ্রেশনের সবচেয়ে ভয়ংকর প্রভাব হতে পারে আত্মহত্যার চিন্তা। ডিপ্রেশনে থাকা ব্যক্তিরা প্রায়শই জীবন সম্পর্কে নেতিবাচক চিন্তাভাবনা করেন। এবং হতাশ হয়ে জীবনের অর্থ খোঁজে পান না। জীবনের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যাওয়ার কারণে তারা আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।

ডিপ্রেশন থেকে বেরিয়ে আসার জন্য মানসিক চিকিৎসা এবং সামাজিক সহযোগিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যারা ডিপ্রেশনে ভোগেন তাদের উচিৎ পরিবারের সাথে কথা বলা, পরামর্শ গ্রহণ করা, এবং পেশাদার মানসিক চিকিৎসক এর পরামর্শ নেওয়া।

সমাধান ও চিকিৎসা

ডিপ্রেশন থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছু কার্যকরী পদ্ধতি রয়েছে। মানসিক চিকিৎসা, থেরাপি, ঔষধ, এবং পরিবারের সহায়তা ডিপ্রেশন কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করতে পারে। এছাড়া শারীরিক ব্যায়াম, সৃষ্টিশীল কার্যক্রম এবং পজেটিভ চিন্তাভাবনার মাধ্যমে ডিপ্রেশন মোকাবেলা করা যায়।

অতএব, ডিপ্রেশন একটি গুরুতর মানসিক সমস্যা হলেও সঠিক সময়ে চিকিৎসা গ্রহণ ও সামাজিক সহায়তা পেলে এটি থেকে উত্তরণ সম্ভব। ডিপ্রেশনের ক্ষেত্রে সামাজিক সচেতনতা এবং সহানুভূতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যাতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা যথাসময়ে সহযোগিতা পান এবং তাদের জীবনের মান উন্নত হয়।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top