
সান্ডা খাওয়া কি হালাল? ইসলামি শরিয়ত, সহীহ হাদিস ও চার মাজহাবের ব্যাখ্যা অনুসারে সাণ্ডা খাওয়া বৈধ কি না—এই প্রশ্ন বহু মুসলিমের মনে ঘোরাফেরা করে। এই আর্টিকেলে আমরা কুরআন, হাদিস এর নির্দেশনা এবং বিভিন্ন মাজহাবের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সান্ডা খাওয়া হালাল না হারাম, তা পর্যালোচনার চেষ্টা করেছি।
সান্ডা বা দব কী?
সান্ডা বা দব (الضب) এক ধরনের মরুভূমির সরীসৃপ প্রাণী, যাকে ইংরেজিতে Spiny-tailed Lizard এবং বৈজ্ঞানিকভাবে Uromastyx বলা হয়। এর দেহ গুইসাপের মতো চওড়া ও লেজটি খসখসে এবং কাঁটাযুক্ত হয়ে থাকে। এই প্রাণীটি মূলত মরু অঞ্চলে দেখা যায়, যেখানে উষ্ণতা বেশি এবং পানি কম পাওয়া যায়। সাধারণত বেদুইন ও গ্রামীণ লোকেদের কাছে প্রিয় সুস্বাদু খাবার। ইসলামে কোন প্রাণী খাওয়া হালাল না হারাম তা নিয়ে সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা রয়েছে। ইসলামী ফিকহ এবং হাদিস অনুযায়ী সান্ডা বা দব খাওয়া কে কীভাবে দেখা হয়, সান্ডা খাওয়া কী হালাল? তা আমরা এখানে বিশদভাবে আলোচনা করব।
সান্ডা বা দবের বৈশিষ্ট্য
সান্ডা বা দব সাধারণত মরুভূমি অঞ্চলে পাওয়া যায় তবে আগের তুলনায় এখন কম পাওয়া যায়। এটি ডিমের মাধ্যমে ববংশবিস্তার করে । প্রাপ্তবয়স্ক সাণ্ডা বা দব এর দৈর্ঘ্য প্রায় ৮৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত হতে পারে। এটি সাধারণত মরুভূমির লতাপাতা, ঘাস ও শস্য খেয়ে মরুভূমির প্রাকৃতিক পরিবেশে বেঁচে থাকে।, যা অন্যান্য সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী থেকে সান্ডা বা দব কে আলাদা করে তোলে।
👉আরও পড়ুন শাপলাপাতা মাছ খাওয়া কি হালাল?
👉আরও পড়ুন পান খাওয়া কি হালাল
সান্ডা খাওয়া হালাল না হারাম? হাদিসে কী বলা হয়েছে।
ইসলামে কোন খাবার হালাল বা হারাম—এ বিষয়ে চূড়ান্ত নির্দেশ আসে কুরআন ও হাদিস থেকে। সাণ্ডা বা দব (আরবি: الضبّ) নামক মরুভূমির এই প্রাণী সম্পর্কে কিছু হাদিসে বর্ণনা পাওয়া যায়।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিজে সাণ্ডা খাননি, তবে একে হারামও বলেননি। নিচে সহীহ হাদিসে এই বিষয়ে কী এসেছে তা তুলে ধরা হলো।
أُهْدِيَ لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ ضَبٌّ، فَلَمْ يَأْكُلْهُ، وَلَا نَهَى عَنْهُ
অনুবাদ: হযরত আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত: “রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে একবার এক লোক সাণ্ডা হাদিয়া দেয়। তিনি তা খাননি, কিন্তু এটিকে হারামও ঘোষণা করেননি।”
سُئِلَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ عَنِ الضَّبِّ، فَقَالَ: لَا آكُلُهُ، وَلَسْتُ أُحَرِّمُهُ
অনুবাদ: হযরত ইবনে ওমর (রাঃ) বর্ণনা করেন: রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে সাণ্ডা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বললেন, “আমি এটি খাই না, তবে এটিকে হারামও বলি না।”
أُتِيَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ بِضَبٍّ مَشْوِيٍّ، فَوُضِعَ بَيْنَ يَدَيْهِ، فَأَهْوَى إِلَيْهِ يَدَهُ، فَقَالَتِ امْرَأَةٌ مِنَ النِّسَاءِ: أَخْبِرُوا رَسُولَ اللَّهِ ﷺ بِمَا يُرِيدُ أَنْ يَأْكُلَ، فَقَالُوا: هُوَ ضَبٌّ يَا رَسُولَ اللَّهِ، فَرَفَعَ يَدَهُ، فَقَالَ: أَكْرَهُهُ، وَلَيْسَ بِحَرَامٍ
অনুবাদ: হযরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন: রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর দস্তরখানায় সাণ্ডা পরিবেশিত হয়েছিল। তিনি ঘৃণার কারণে তা খাননি, কিন্তু এটিকে হারামও বলেননি। সাহাবীরা তা খেয়েছিলেন।
হাদিস থেকে কী বোঝা যায়?
উল্লিখিত সহীহ হাদিসসমূহ থেকে বোঝা যায় যে, সান্ডা খাওয়া ইসলামে হারাম নয়, বরং হালাল। রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) নিজে এটি খাননি, তবে কখনোই নিষিদ্ধ ঘোষণা করেননি। সাহাবায়ে কেরাম (রাঃ) এটি খেয়েছেন এবং তিনি তাদের খেতে বাধাও দেননি।
ইসলামি ফিকাহ অনুযায়ী, এমন প্রাণী যা পবিত্র, অ-বিষাক্ত এবং শরিয়তে নিষিদ্ধ নয়—তা খাওয়া বৈধ। সাণ্ডা মরুভূমির একটি নির্দিষ্ট প্রজাতির প্রাণী, যেটি আরব অঞ্চলে প্রচলিত খাদ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। নবিজির দস্তরখানায় সাণ্ডা পরিবেশিত হওয়াটিও এর বৈধতার স্পষ্ট প্রমাণ।
তবে কেউ চাইলে ব্যক্তিগত রুচির কারণে এটি এড়িয়ে চলতে পারেন। কিন্তু একে হারাম বলা ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে সঠিক নয়। এই হাদিসগুলো থেকে আমরা বুঝতে পারি যে, ইসলাম শুধুমাত্র শরয়ী নির্দেশনাই দেয় না, বরং মানুষের রুচি ও স্বাভাবিক প্রবৃত্তির প্রতিও গুরুত্ব প্রদান করে।
👉আরও পড়ুন ধুমপান কি যায়েজ
ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী সান্ডা খাওয়া
ফিকহের বিভিন্ন মাজহাব সাণ্ডা খাওয়ার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করে।
- শাফেয়ী ও মালিকি মাজব: এই মাজহাব অনুযায়ী, সাণ্ডা খাওয়া হালাল। কারণ রাসূলুল্লাহ (সা) নিজে সাণ্ডা খাওয়া হারাম ঘোষণা করেননি।
- হানাফি মাজহাব: হানাফি আলেমগণ এটিকে মাকরূহ বলেছেন। তবে মাকরূহ হওয়া বলেই তা হারাম নয়। এটি না খাওয়াই উত্তম বলে মনে করেন তারা।
- হাম্বলি মাজহাব: এই মাজহাবেও সাণ্ডা খাওয়াকে বৈধ হিসেবে গণ্য করা হয়।
অতএব ইসলামি শরিয়তের আলোকে সান্ডা খাওয়া বৈধ, তবে কেউ ব্যাক্তিগত অপছন্দে তা এড়িয়ে চলতে পারে।
সান্ডা ও গুইসাপ কি একই প্রাণী? ইসলামি ফিকহ অনুযায়ী বিশ্লেষণ

অনেকের মনে প্রশ্ন জাগে, হাদিসে বর্ণিত সাণ্ডা (Uromastyx) এবং আমাদের দেশে খাল, বিলে, নদী নালায় বা জংগলে যে গুইসাপ (Monitor Lizard) কি একই প্রাণী? আসলে তারা আলাদা এবং ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকেও এদের খাদ্য হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা ভিন্ন।
সাণ্ডা (Uromastyx):
- মরুভূমিতে বাস করে।
- নিরামিষভোজী।
- শরীর এবং লেজ খসখসে
- এটি বিষাক্ত নয় এবং সাপ জাতীয় প্রাণী নয়।
গুইসাপ (Monitor lizard):
- উভচর প্রাণী।
- মাংসাশী এবং মৃত প্রাণী খায়। মাঝে গ্রাম অঞ্চলে দেখেছি গুইসাপ ছোট ছোট মুরগির বাচ্চা ধরে নিয়ে যেতো, এবং ব্যাঙ ধরে খেতো, আমরা ছোট বেলা গুইসাপ কে কুমির মনে করতাম এবং ভিষণ ভয় পেতাম যদি বাচ্চাদের উপর আক্রমণ করে। যদিও এরা বাচ্চাদের আক্রমণ করে না।
- যদিও বাহ্যিকভাবে সান্ডার সাথে কিছুটা মিল রয়েছে, তবুও গুইসাপের চলাফেরা ও শিকার ধরার ভঙ্গি অনেকটাই কুমিরের মতো।”
- পরিবেশের জন্য উপকারী হলেও গুইসাপ এমন প্রাণী যা মৃতজীব খায় এবং নাপাক জিনিস খাওয়ার কারণে ইসলামী ফিকাহবিদগণ একে হারাম বলে অভিহিত করেছেন।
অতএব, সাণ্ডা ও গুইসাপ দেখতে কিছুটা মিল থাকলেও বাসস্থান, খাদ্যাভ্যাস ও স্বভাবগত দিক থেকে তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইসলামি ফিকহ মতে, সাণ্ডা খাওয়া হালাল, তবে গুইসাপ খাওয়া নিষিদ্ধ, কারণ এটি নাপাক ও মৃতজীব খায়।
✅ ইসলামি শরিয়ত অনুযায়ী সাণ্ডা হালাল হওয়ার কারণসমূহ
- নবিজির (সা.) নিরব সম্মতি: রাসূলুল্লাহ (সা.) নিজে সাণ্ডা খাননি, তবে সাহাবিরা তাঁর সামনে তা খেয়েছেন এবং তিনি তা থেকে নিষেধ করেননি। (তিরমিযি: 1799, মুসলিম: 1944)
- ফকিহদের একমত মতামত: ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক এবং ইমাম আহমদ (রহ.)-এর মতে সাণ্ডা খাওয়া হালাল, কারণ এর বিরুদ্ধে কোনো নিষেধাজ্ঞা নেই।
- স্বাভাবিক বৈধতা ও পরিচ্ছন্নতা: সাণ্ডা নিরামিষভোজী, বিষাক্ত নয় এবং পরিবেশের ক্ষতি করে না, ফলে শরিয়তের বৈধ খাদ্যের মানদণ্ডে এটি পড়ে।
১. রাসূলুল্লাহ ( সা)-এর অনুমতি : রাসূলুল্লাহ (সা) সাণ্ডাকে হারাম ঘোষণা করেননি এবং সাহাবিরা তার সামনে এটি খেয়েছেন।
২.অধিকাংশ আলেমদের অভিমত : ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালিক এবং অন্যান্য ফকিহদের মতে সাণ্ডা খাওয়া হালাল।
৩. বিষাক্ত নয়: সাণ্ডা কোনো বিষাক্ত প্রাণী নয়। এটি নিরামিষভোজী এবং পরিবেশের ক্ষতি করে না।
সাণ্ডা খাওয়ার সম্ভাব্য উপকারিতা
মরুভূমি অঞ্চলে প্রচলিত এই প্রাণীটির মাংস পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ বলে স্থানীয়রা বিশ্বাস করেন। এতে প্রোটিন, কম চর্বি এবং কিছু প্রাকৃতিক খনিজ উপাদান রয়েছে। সঠিকভাবে রান্না করলে এটি শরীরের শক্তি ও পেশি গঠনে সহায়ক হতে পারে।
সাণ্ডা তেলের লোকজ ব্যবহার
সাণ্ডার তেল ঐতিহ্যগতভাবে লোকজ চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। এটি বিভিন্ন অঞ্চলে গেঁটে বাত, ত্বকের সমস্যা, ও চুলের যত্নে ব্যবহৃত হয়। তবে এই সব ব্যবহার সম্পূর্ণভাবে গবেষণাভিত্তিক নয়।
সতর্কতা: প্রাকৃতিক হলেও, সাণ্ডা তেল ব্যবহারের আগে তার বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করুন।
যদি কেউ সান্ডা খেতে চায়
যেহেতু এটি হালাল, তাই যদি কেউ এটি খেতে চায়। তবে ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী তা প্রস্তুত করতে হবে। সাণ্ডা জবাই করতে হলে সাধারণ নিয়মে আল্লাহর নাম নিয়ে তা জবাই করতে হবে।
সান্ডা খাওয়া কি হাদিসে হালাল বলা হয়েছে?
✔️ সহীহ হাদিস অনুযায়ী, রাসূল (সা.) নিজে খাননি, তবে নিষেধ করেননি। তাই এটি হালাল।
দব বা সান্ডা এবং গুইসাপ কি এক?
✔️ না, সান্ডা নিরামিষভোজী মরুভূমির প্রাণী, আর গুইসাপ মাংসাশী ও হারাম।
সান্ডা খেলে কি উপকার হয়?
✔️ এটি প্রোটিন সমৃদ্ধ, কম চর্বিযুক্ত, শক্তি বাড়ায়।
ইসলামে কোন প্রাণী খাওয়া হারাম বলেছে?
✔️ মৃত প্রাণী, রক্ত, শূকর ও নাপাক খাদক ও মাংসাশী প্রাণী খাওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ।
উপসংহার
এটি ইসলামের খাদ্যবিধি এবং নবীজির সুন্নাহর প্রতি সম্মান দেখিয়ে খাওয়া যেতে পারে। তবে না খাওয়ারও কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটি খাওয়া কিংবা এড়িয়ে যাওয়া উভয়টাই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে গ্রহণযোগ্য।