অহংকারী মানুষ চেনার উপায়

Spread the love

অহংকার মানুষের ব্যক্তিত্বের এমন এক দিক, যা কখনো কখনো তাদের সামাজিক ও পেশাগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অহংকারী মানুষ সাধারণত নিজেদের অন্যদের থেকে আলাদা এবং বড় কিছু মনে করে, যা তাদের আচরণে প্রতিফলিত হয়। এই আর্টিকেলে আমরা অহংকারী মানুষ চেনার উপায় এবং বৈশিষ্ট্য, তাদের আচরণ, এবং অহংকারের প্রকারভেদ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

অহংকারী মানুষ চেনার উপায়

অহংকার অর্থ কি?

“অহংকার” শব্দটি সাধারণত নিজের প্রতি অতিরিক্ত উচ্চ ধারণা বা অন্যদের প্রতি তুচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গিকে বোঝায়।
অর্থ: নিজেকে সবার থেকে বড় মনে করা এবং অন্যদের অবজ্ঞা করা।

অহংকার এর সন্ধি বিচ্ছেদ

অহংকার শব্দটির সন্ধি বিচ্ছেদ হলো:
অহং + কার

  • অহং: এটি সংস্কৃত শব্দ, যার অর্থ “আমি” বা “স্ব”।
  • কার: এটি অর্থ নির্দেশ করে “কর্ম” বা “প্রভাব”।
    সুতরাং, অহংকারের অর্থ দাঁড়ায়, “নিজেকে বড় মনে করে প্রভাব দেখানো।”

অহংকার কাকে বলে?

অহংকার হলো নিজের যোগ্যতা, সম্পদ, বা অবস্থান নিয়ে অতিরিক্ত গর্ব করা এবং অন্যদের ছোট বা তুচ্ছ মনে করা। এটি এমন একটি মানসিক অবস্থা, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করে। ইসলামে অহংকারকে নিন্দনীয় এবং গুনাহ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।

অহংকার কত প্রকার?

অহংকারকে সাধারণত দুটি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়:

  1. আত্মকেন্দ্রিক অহংকার: এই ধরনের অহংকারীরা নিজের স্বার্থ এবং সাফল্য নিয়ে ব্যস্ত থাকে। তারা অন্যদের কষ্ট বা প্রয়োজনকে অবহেলা করে।
  2. সামাজিক অহংকার: এই ধরনের অহংকারীরা তাদের সামাজিক অবস্থান, সম্পদ, বা ক্ষমতা দেখিয়ে অন্যদের চেয়ে নিজেকে উঁচু মনে করে।

অহংকারীরা কেমন আচরণ করে?

অহংকারী মানুষদের চেনার জন্য তাদের কিছু বিশেষ আচরণ লক্ষ্য করা যায়। নিচে তাদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য তুলে ধরা হলো:

অহংকার
  1. নিজেকে বড় মনে করা: তারা সবসময় নিজেদের অন্যদের চেয়ে বেশি যোগ্য, জ্ঞানী, বা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে।
  2. অন্যদের তুচ্ছ করা: অহংকারীরা সাধারণত অন্যদের অর্জন, দক্ষতা বা পরিশ্রমকে ছোট করে দেখে।
  3. অন্যের সমালোচনায় তৎপর: তারা অন্যদের ভুল ধরতে ভালোবাসে এবং সুযোগ পেলেই সমালোচনা করে।
  4. সহযোগিতার অভাব: অহংকারী ব্যক্তি সাধারণত দলগত কাজ বা সহযোগিতার ক্ষেত্রে সাড়া দেয় না, বরং নিজের সাফল্য নিয়ে বেশি ব্যস্ত থাকে।
  5. গর্বপূর্ণ ভাষা ব্যবহার: তারা কথায় ও কাজের মাধ্যমে নিজের অর্জন বা দক্ষতা বাড়িয়ে বলতে পছন্দ করে।

অহংকার কি খারাপ জিনিস?

অহংকারের প্রকৃতি এবং তার প্রভাব বিবেচনা করলে দেখা যায়, এটি একটি নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য যা ব্যক্তি ও সমাজের জন্য ক্ষতিকারক।

অহংকার
  1. সম্পর্ক নষ্ট করে: অহংকারী আচরণ পারিবারিক, সামাজিক এবং পেশাগত সম্পর্ককে দুর্বল করে।
  2. শিক্ষা গ্রহণে বাধা সৃষ্টি: অহংকারীরা নতুন কিছু শেখার চেষ্টায় আগ্রহ হারায়, কারণ তারা মনে করে তারা সব জানে।
  3. ব্যক্তিত্বের বিকাশে প্রতিবন্ধক: অহংকারের কারণে মানুষ নিজের ভুল স্বীকার করে শেখার সুযোগ হারায়।
  4. মানসিক চাপ: অহংকারী মানুষ নিজেরা সবসময় একটি চাপের মধ্যে থাকে, কারণ তাদের নিজেদের বড় দেখানোর জন্য সবসময় চেষ্টা করতে হয়।

ইসলামে অহংকার কি?

ইসলাম অহংকারকে অত্যন্ত নিন্দনীয় এবং পাপ হিসেবে বর্ণনা করেছে। কুরআন ও হাদিসে অহংকারকে এমন এক গুণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যা মানুষের অন্তরকে কঠিন করে এবং তাকে আল্লাহর রহমত থেকে দূরে সরিয়ে দেয়।

  1. কুরআনে সতর্কবার্তা:
    আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
    “নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী ও অহমিকা প্রদর্শনকারীকে পছন্দ করেন না।” (সূরা লুকমান: ১৮)
  2. শয়তানের উদাহরণ:
    শয়তানের পতনের প্রধান কারণ ছিল তার অহংকার। সে আদমকে সিজদা করতে অস্বীকার করেছিল, কারণ সে নিজেকে উত্তম মনে করেছিল।
  3. নবী করিম (সা.)-এর সতর্কবার্তা:
    রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,
    “যে ব্যক্তি তার অন্তরে অণু পরিমাণ অহংকার রাখে, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।” (সহিহ মুসলিম)

ইসলামে বিনম্রতা এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্যকে উৎসাহিত করা হয়। অহংকার থেকে মুক্ত থাকার জন্য একজন মুমিনকে সবসময় আল্লাহর দরবারে নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করতে হবে।

অহংকার কখন বেশি হয়?

অহংকার সাধারণত এমন পরিস্থিতিতে বৃদ্ধি পায়, যখন মানুষ নিজেকে অন্যদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ মনে করে। নিচে কিছু সাধারণ কারণ উল্লেখ করা হলো:

অহংকার
  1. ধন-সম্পদের কারণে:
    যারা সম্পদশালী হয়, তারা অনেক সময় নিজেদের বড় বলে ভাবতে শুরু করে এবং গরীবদের তুচ্ছ জ্ঞান করে।
  2. জ্ঞান বা দক্ষতার কারণে:
    বিশেষজ্ঞ বা শিক্ষিত ব্যক্তি অনেক সময় নিজেদের জ্ঞান নিয়ে গর্ববোধ করে, যা অহংকারের জন্ম দেয়।
  3. সামাজিক মর্যাদার কারণে:
    উচ্চ সামাজিক অবস্থানে থাকা মানুষ নিজের মর্যাদা নিয়ে অহংকার করতে পারে এবং নিম্নবর্গের মানুষকে ছোট করে দেখে।
  4. অধিক ক্ষমতা বা নেতৃত্বের কারণে:
    যারা বড় পদে থাকে বা নেতৃত্ব দেয়, তারা অনেক সময় ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং অহংকারী হয়ে ওঠে।
  5. প্রশংসার অভ্যাস:
    কেউ যদি সবসময় অন্যদের কাছ থেকে প্রশংসা পায়, তবে সেটি তাকে অহংকারী বানিয়ে তুলতে পারে।

অহংকার তখনই কমানো সম্ভব, যখন মানুষ নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝতে শিখবে এবং আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। নিজেকে সবসময় অন্যদের মতোই একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে দেখা এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।

অহংকার দূর করার উপায়

অহংকার একটি মানসিক ব্যাধি যা ধীরে ধীরে মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়। তবে সচেতনতা ও আত্ম-উপলব্ধির মাধ্যমে এটি দূর করা সম্ভব। নিচে অহংকার দূর করার কিছু কার্যকর উপায় দেওয়া হলো:

অহংকার
  1. আত্মসমালোচনা করা: নিজের ভুল ও দুর্বলতাগুলো নিয়ে চিন্তা করা এবং তা মেনে নেওয়ার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
  2. আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা: সবকিছুর মালিক আল্লাহ, এ কথা মেনে নিয়ে তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকলে অহংকার দূরে থাকবে।
  3. বিনম্রতা চর্চা: মানুষকে সম্মান করা এবং বিনয়ের সাথে কথা বলার অভ্যাস গড়ে তুলুন।
  4. অন্যের গুণাবলি প্রশংসা করা: অন্যের কৃতিত্বকে স্বীকার করুন এবং তাদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হন।
  5. দরিদ্র ও অসহায়দের সাথে সময় কাটানো: তাদের কষ্ট ও সংগ্রামের কথা শুনলে অহংকার দূর হবে।
  6. ইসলামের শিক্ষা অনুসরণ করা: নিয়মিত নামাজ পড়া, কুরআন অধ্যয়ন, এবং রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর জীবনচর্চা অনুসরণ করে অহংকার পরিহার করা সম্ভব।

অহংকার পতনের মূল

অহংকার মানুষকে অন্ধ করে তোলে এবং নিজের সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করতে বাধা দেয়। নিচে অহংকার পতনের কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হলো:

  1. অলক্ষ্যে শত্রু সৃষ্টি করা: অহংকারী মানুষদের চারপাশে শত্রু তৈরি হয়, কারণ তাদের আচরণ অন্যদের ক্ষুব্ধ করে।
  2. নিজের ভুলে পতন: অহংকার মানুষকে ভুল সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করে, কারণ তারা অন্যদের পরামর্শ গ্রহণ করতে চায় না।
  3. মানুষের বিচ্ছিন্নতা: অহংকারী ব্যক্তি সামাজিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ে, কারণ মানুষ তাদের এড়িয়ে চলে।
  4. আল্লাহর অসন্তুষ্টি: আল্লাহ অহংকারী মানুষকে পছন্দ করেন না, এবং তাদের প্রতি শাস্তি নেমে আসে।

উপসংহার

অহংকার মানুষকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যায়, তাই এটি থেকে মুক্তি পাওয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অহংকার দূর করতে বিনম্রতা, ধৈর্য, এবং আল্লাহর প্রতি গভীর আনুগত্য প্রয়োজন। একজন প্রকৃত মুমিন সবসময় নিজের দুর্বলতা স্বীকার করে, আল্লাহর রহমতের ওপর নির্ভর করে এবং মানুষকে সম্মান করে চলে। এই গুণাবলির মাধ্যমেই আমরা অহংকার থেকে মুক্ত হয়ে একজন ভালো মানুষ ও সৎ মুসলিম হয়ে উঠতে পারি।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top